শুক্রবার, ১২ জুলাই, ২০১৩

ভালো নেই বহ্মপুত্র পাড়ের জনপদ

ময়মনসিংহ: ভাটিপাড়া গ্রাম ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে মাত্র এক দশক আগেও ৮০ কিলোমিটার দূরে ছিল। প্রতিবারই বর্ষায় ভেঙেছে এ গ্রামের কিনারা। গত ৫ বছরে নদী তীরের প্রায় দুই শতাধিক বাড়ি ভাঙনের কবলে পড়েছে।

ভাঙন অব্যাহত থাকলে এ বছরেই অবশিষ্ট বাড়িঘর সরিয়ে নিতে হবে। এরইমধ্যে ভাঙনের মুখে পড়ে শতাধিক পরিবার তাদের ভিটেমাটি ও বসতভিটা স্থানান্তর করেছেন। সর্বনাশা এ ভাঙনে কাঁদছে স্থানীয় বাসিন্দারা। 

স্থানীয় সূত্র জানায়, গত এক মাসে ব্রহ্মপুত্রের তীব্র ভাঙনের মুখে পড়েছে গৌরীপুর উপজেলার ভাংনামারি ইউনিয়নের অনন্তগঞ্জ, ঈশ্বরগঞ্জের উছাখিলা ইউনিয়নের মুন্সীবাড়ী, বড়ইকান্দি, চরআলগী, নামাপাড়া, সদর উপজেলার কুষ্টিয়া ইউনিয়নের চরদড়িকুষ্টিয়া, হইয়ারকান্দি ও নামাপাড়া গ্রাম। 

এসব ইউনিয়নের প্রায় ৩ শতাধিক পরিবার বাড়ি-ঘর ছাড়া ও অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে গেছেন। ব্রহ্মপুত্রের অব্যাহত ভাঙনে হুমকির মুখে রয়েছে বেগুনবাড়ী-রূপাখালী গ্রাম। কারণ এ গ্রামের মধ্যে দিয়েই গেছে ময়মনসিংহ-জামালপুর রেলপথ। 

এছাড়া ভাঙনের আশঙ্কায় রয়েছে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার গাঙিনাপাড় থেকে শুরু করে বটতলা বালুঘাট, কুটেরচর, লাটিয়ামারি উজান চরণপাড়া ও যাদুয়ারচর গ্রাম। 

নদী ভাঙন কতো ভয়ঙ্কর তা ভালো করেই জানেন অনন্তগঞ্জ গ্রামের মোবারক হোসেন (৪৫)। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘ভাঙনের কারণে এক মাসে দুইবার বাড়ি সরাইছি। অহন আবার সরাইন লাগবো। এ ব্রক্ষপুত্র আমাগোর সব কাইড়্যা নিচ্ছে।’

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শুধুমাত্র গত বছরেই ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার ভাঙনামারি ইউনিয়নের পশ্চিম ভাটিপাড়া ও পূর্ব ভাটিপাড়া গ্রাম ব্রহ্মপুত্রের ভয়াবহ ভাঙনের মুখে পড়ে। ওই বছর ৪০টি বাড়ি ও এক হাজার একর ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ফসলের জমি হারিয়ে নি:স্ব মানুষ ভূমিহীন পরিবারে পরিণত হয়েছে। 

এর আগে ভাঙনামারি ইউনিয়নের মরিচারচর, খোদাবক্সপুরসহ ১০ থেকে ১২টি এলাকায় অব্যাহতভাবে ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনের মুখে পড়লেও ভাঙনরোধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে অসংখ্য পরিবার বাড়িঘর হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়েছে। 

নদী ভাঙনে সর্বস্ব হারানো ভাটিপাড়া গ্রামের উমেদ আলী (৪০) বলেন, ‘গেল বারের ভাঙনে আমার ১০ একর জমি নদীর পেটে চলে গেছে। এহন মাইনষের বাড়িত কাম কইরা খাই।’

নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত মরিচারচর এলাকার ছমির উদ্দিন (৫০) বলেন, ‘নদী আমাদের স্বপ্ন-সাধ কেড়ে নিচ্ছে। কিন্তু স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এ ভাঙন রোধে এগিয়ে আসছেন না।’

এ বিষয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল হক সরকার বলেন, ‘ভাঙন শুরুর পর স্থানীয় সাংসদ, উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ভাঙন রোধের ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করলেও ভাঙন ঠেকাতে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি তাদের পক্ষ থেকে।’ 

নদী ভাঙন রোধের ব্যাপারে গৌরীপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলী আহমদ খান পাঠান ভাঙন এলাকায় বাধ নির্মাণ করে দেওয়ার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করেছেন বলে জানিয়েছেন।

ময়মনসিংহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ভাঙন রোধে বাধ নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্পের প্রস্তাব জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে কোন অনুমোদন আসেনি।’

দেখা গেছে, গৌরীপুরের ভাঙনামারি ইউনিয়ন ছাড়াও ময়মনসিংহ সদরের চরাঞ্চলের বোরোরচর ও পরানগঞ্জ এলাকায় রয়েছে নদী ভাঙনের তীব্রতা। গত বিএনপি সরকারের সময়ে বোরারচরে ভাঙন তীব্রতর হলে এলাকায় বাধ নির্মাণের দাবিতে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। এরপর স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রকল্প গ্রহণ করলেও এখন আবার নতুন করে ব্রহ্মপুত্র ভাঙছে। 

একাধিক সূত্র জানায়, ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন রোধে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) এলাকায় কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে শহর রক্ষা বাধ নির্মাণ কাজ করা হলেও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে সে কাজ হওয়ায় এ বাধের স্থায়ীত্ব নিয়ে সংশয় রয়েছে। 

একইভাবে ত্রিশালের ফাতেমা নগর বাজারের কাছে এবং গফরগাঁওয়ের বিভিন্ন এলাকায়ও ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন দেখা দিয়েছে। ব্রহ্মপুত্র শাসনে কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় ভাঙনরোধে কোন পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন হচ্ছে না। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন